আপডেটের সময়ঃ জুলাই ৯, ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূব অংশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত জনপদ “পার্বত্য চট্টগ্রাম”। এ জনপদে রয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ,নৃ-বৈচিত্র্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য , যা এ জনপদকে অপার সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে থেকে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে যোগাযোগ, শিক্ষা,তথ্য-প্রযুক্তি,শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ,কৃষি ও পানীয় জল ব্যবস্থাপনা,ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ,পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশ,নারীর ক্ষমত্য়ান, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ২০০৯ হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়নে কাজ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে-
রাস্তা নির্মাণ:– রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দবান জেলায় মোট পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ৫০৯.১৪ কি:মি:। পাকাঁ ব্রীজ:- উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)পাকাঁ ব্রীজ নির্মিত হয়েছে সর্বমোট ২২০৪.৫৪ মি:।
কালভার্ট:- তিন পার্বত্য জেলায় কালভার্ট নির্মিত হয়েছে সর্বমোট কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে ৬৬৩.৫৪ মিটার।
কৃষি :- রাঙামাটিতে কৃষি সরঞ্জাম হিসেবে কৃষকদের মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় পাওয়ার টিলার বিতরণ করেছেন ০৬টি, বান্দরবানে বিতরণ করেছেন৭৯টি, সর্বমোট ৮৫টি পাওয়ার টিলা বিতরণ করা হয়।বান্দরবান পার্বত্য জেলায় প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ৬৫টি পাম্প মেশিন বিতরণ করেছেন।
ধান মাড়াই কল:-বান্দরবানে কৃষকদের মাঝে ধান মাড়াই কল বিতরণ করা হয়েছে ৮০টি। কমবাইন হার্ভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে ৪টি।
সেচ নালা/ড্রেন নির্মাণ:-পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ২৯০৪৮.২৯ মিটার সেচ নালা/ড্রেন নির্মাণ নির্মাণ করা হয়েছে । বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে ৪৫০ মিটার।
শিক্ষা:- পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অর্থায়নে রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় ২৭টি বিদ্যালয় ভবন নির্মান করেন (৪৫৪৫ বর্গ মিটার) খাগড়াছড়ি জেলায় নির্মাণ করা হয় ৬৪টি বিদ্যালয় ভবন (৭৩৪৯ বর্গ মিটার)।বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ১০৭ টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে (১৯৪৬৯.৯৬ বর্গ মিটার)।
সর্বমোট ১৯৮টি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয় (৩১৩৬৩.৯৬ বর্গ মিটার)। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ১টি বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয় ভবনও নির্মিত হয়েছে(৪১৮০বর্গ মিটার)।
শিক্ষাবৃত্তি প্রদান: তিন পার্বত্য জেলায় এই পর্যন্ত ১৫,৫৪৬ জন ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর হতে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য :- উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে বান্দরবানে একটি হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে। (১৬৭২.২০ বর্গ মিটার) ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পরিমান :-
অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বোর্ড রাঙামাটিসহ ৩ পার্বত্য জেলায় ২৩০ টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন।
নারী উন্নয়ন, আয়বর্ধক কর্মকান্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন:-পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প:-
বিগত ১৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নাধীন টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য এলাকায় শিশু ও তাদের পরিবারের নিকট মৌলিক সামাজিক সেবা সমূহের প্রাপ্যতা বৃদ্ধিকরণের জন্য ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ১ লক্ষ ২০ হাজার শিশুদের প্রাক-শৈশব স্তরে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ২লক্ষ ৬ হাজার পরিবারের শিশু, কিশোরী ও মহিলাদের রক্তস্বল্পতা ও পুষ্টি ঘাটতি জনিত সমস্যা প্রতিরোধ করা হয়েছে। পাহাড়ের ৪টি আবাসিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির (বৃত্তিমূলক কোর্সসহ) ১ হাজার ২শ জন শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবাহের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পের আওতায় ২০২০- ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার কৃষক পরিবারকে অর্ন্তভুক্ত করে ১ একরের ৮০০ টি কফি ও ১ হাজার ২শ টি কাজুবাদাম বাগান সৃজনের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রম তিন পার্বত্য জেলার মোট ১২ টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উক্ত প্রকল্পে ১ একর করে ৮শটি কফি ও ১ হাজার ২শ টি কাজুবাদাম বাগান সৃজনের মাধ্যমে ২ হাজার পরিবারের আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প:
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নাধীন “পার্বত্য চট্টগ্রামে তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচন” শীর্ষক প্রকল্পটি রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তনে আপল্যান্ড তুলার চাষ সম্প্রসারণে কাজ চলমান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ:
তিন পার্বত্য জেলায় মোট ৫০,৮৯০ সেট সোলার হোম সিস্টেম ও ৫,৩১৪ সেট সোলার কমিউনিটি সিস্টেম বিতরণ ও স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে পাহাড়ে প্রত্যন্ত এলাকার (বিদুৎ সুবিধা বঞ্চিত) সাধারণ মানুষরা বিদুৎ সুবিধা পাচ্ছেন।
তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্যাঞ্চলের বেকার যুবক-যুবমহিলা ও আগ্রহী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইসিটি বিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ ও আউটসোর্সিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩০০ জন বেকার যুবক-যুবমহিলাকে কম্পিউটার বিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং উচ্চতর বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ২০২১-২০২৩ মেয়াদে আরো ৪০ জন বেকার যুবক-যুবমহিলাকে সোস্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, এ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেমন, গ্রাফিক্স, অডিও-ভিডিও, এ্যানিমেশন, ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার এবং আউটসোর্র্সিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ স্কিমটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন মাসে সম্পন্ন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মূর্যাল:-
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্মৃতিকে চির স্মরণীয় করে রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ৭১ ফুট উচ্চতায় এ মুর্যালটি নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এই মুর্যাল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এতো বেশি উচ্চতায় এর আগে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মুর্যাল নির্মিত হয়নি।
এদিকে,লংগদুর বগাচতর ইউপির বাসিন্দা হাসান আলী ও রফিক জানান, আগে কেরোসিনের কুপি দিয়ে রাতের বেলায় ঘরের আলো জ¦লতো। এখন উন্নয়ন বোর্ড থেকে সোলার পাওয়া পর আমাদের জীবন পাল্টে গেছে। তারা বলেন, ছেলেমেয়েরা আগে বাতি জ¦ালিয়ে পড়ালেখা করতো। বেশিক্ষণ পড়ালেখা করতে পারতো না। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া সোলার প্যানেল সিস্টেম দিয়ে সৌর বিদ্যুতের আলোয় রাত জেগে পড়ালেখা করতে তারা। এতে তারা বেশ খুশি ও আনন্দিত।
লংগদুর বগাচত্বর এলাকার আরেক বাসিন্দা জেসমিন আক্তার জানান, বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে আমরা রাস্তা-ঘাট , বিদুৎ পেয়ে আমরা অনেক খুশি।
রাঙামাটির রাজস্থলীর গাইন্দ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা জেবুমনি ত্রিপুরা ও অজয় ত্রিপুরা জানান, শিক্ষা ,চিকিৎসা ও যোগাযোগের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড অনেক ভূমিকা রাখছে। তারা বলেন,আমাদের এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ পাওয়ায় তাদের গ্রাম আলোকিত হয়েছে।
রাজস্থলী উপজেলার ১ নম্বর ঘিলাছড়ি ইউপির চেয়ারম্যান রবার্ট ত্রিপুরা জানান, তাদের গ্রামটি বেশ দুর্গম। সেখানে আগে অন্ধকার ছিলো। এখন আলোকিত। তিনি বলেন, পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে উন্নয়ন বোর্যের মাধ্যমে।
বিলাইছড়ি উপজেলার ১২০ তিনকোনীয় মৌজার হেডম্যান লালএ্যাংলীয়ানা পাংখোয়া জানান, তাদের পাংখোয়া পাড়াতে ১২০ পরিবারের বসবাস। তাদের জন্য উন্নয়ন বোর্ড একটি কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বিগত ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলায় অনেক উন্নয়ন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। তিনি বলেন, এ এলাকায় উন্নয়ন বোর্ড প্রচুর রাস্তা-ঘাট তৈরী করেছে যার সুফল বর্তমানে এলাকার জনগণ ভোগ করছেন।যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এখানকার উৎপাদিত কৃষি পন্য
একদিনের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌছে যাচ্ছে। সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, আমরা চাই পাহাড়ে আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। কারন শিক্ষার হারে এই এলাকাটি এখনো পিছিয়ে রয়েছে। এখানে শিক্ষার হারকে আরো বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এখানকার পশ্চাদপদ এলাকাকে আমরা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়িত
করছি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমরা ২ থেকে আড়াই লক্ষ প্রত্যন্ত এলাকার পরিবারকে সোলার বিদ্যুতের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা আরো বলেন, এখানকার পাহাড়ী-বাঙালী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে এখানকার পর্যটনের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।